বাংলা ভাষা শুধু একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন এবং ভারতের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে বাংলা ভাষা বিশ্বব্যাপী সম্মানিত। কিন্তু সম্প্রতি দিল্লি পুলিশের একটি চিঠি এই ভাষার পরিচয় নিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। চিঠিতে বাংলা ভাষাকে “বাংলাদেশি ভাষা” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ভারতের বাংলাভাষী সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা কেবল ভাষাগত সংবেদনশীলতার প্রশ্নই নয়, ভারতের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সম্পর্কের গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
ঘটনার পটভূমি
২০২৫ সালের ২৪ জুলাই, দিল্লি পুলিশের লোধী কলোনি থানার ইন্সপেক্টর অমিত দত্ত বঙ্গ ভবনের কাছে একটি চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে বাংলাদেশি নাগরিক বলে সন্দেহভাজন আটজন ব্যক্তির কাছ থেকে জব্দ করা নথিপত্র (যেমন: জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ, ব্যাংক বিবরণী) অনুবাদের জন্য সাহায্য চাওয়া হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে এই নথিগুলো “বাংলাদেশি জাতীয় ভাষায়” লেখা, এবং এগুলো হিন্দি ও ইংরেজিতে অনুবাদ করা প্রয়োজন। এই “বাংলাদেশি ভাষা” শব্দটি বাংলা ভাষাকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করার ইঙ্গিত দেয়, যা ভারতের বাংলাভাষী সম্প্রদায়ের জন্য অপমানজনক বলে বিবেচিত হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: টিএমসির তীব্র প্রতিবাদ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনাকে “কলঙ্কজনক, অপমানজনক, দেশবিরোধী এবং অসাংবিধানিক” বলে নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন,
“বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দের ভাষা। এটি ভারতের জাতীয় সংগীত ও জাতীয় গানের ভাষা, যা সংবিধানে অষ্টম তফসিলে স্বীকৃত। এই ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে অভিহিত করা কোটি কোটি বাংলাভাষীর প্রতি অপমান।”
তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপকে “বাংলা-বিরোধী” বলে অভিহিত করে সমস্ত বাংলাভাষীকে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েছেন।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি
টিএমসির মহাসচিব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনাকে বিজেপির “সুপরিকল্পিত চক্রান্ত” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এটি বাংলার সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ক্ষুণ্ন করার এবং পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশের সঙ্গে সমতুল্য করে দেখানোর একটি রাজনৈতিক কৌশল। তিনি দিল্লি পুলিশের অফিসার অমিত দত্তের সাসপেনশন এবং দিল্লি পুলিশ, বিজেপি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন,
“বাংলাদেশি ভাষা বলে কোনো ভাষা নেই। এটি সংবিধানের ৩৪৩ ধারা এবং অষ্টম তফসিলের সরাসরি লঙ্ঘন।”
অন্যান্য নেতাদের সমর্থন
এই বিতর্কে টিএমসি একা নয়। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্টালিন এই পদক্ষেপকে জাতীয় সংগীতের ভাষার প্রতি অপমান বলে নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, “এটি ভারতের বহুভাষিক ঐতিহ্যের প্রতি আঘাত।” ত্রিপুরার তিপরা মোঠার নেতা প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মা এটিকে “গভীরভাবে চিন্তাজনক” এবং “অজ্ঞতাপূর্ণ” বলে অভিহিত করেছেন। সিপিআই(এম) নেতা মোহাম্মদ সালিম দিল্লি পুলিশকে “অশিক্ষিত” বলে সমালোচনা করে প্রশ্ন তুলেছেন, “‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?”
বিজেপির প্রতিরক্ষা
বিজেপি এই অভিযোগের বিরুদ্ধে নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। বিজেপির আইটি সেল প্রধান আমিত মালভিয়া বলেছেন,
“‘বাংলাদেশি ভাষা’ শব্দটি শুধুমাত্র অবৈধ অভিবাসীদের নথির ভাষাগত প্রেক্ষাপট বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, বাংলা ভাষাকে অপমান করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।”
তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর পাল্টা অভিযোগ করে বলেছেন, তিনি “ভোটব্যাংক রাজনীতি” এবং “ভাষাগত দ্বন্দ্ব” সৃষ্টির জন্য এই ঘটনাকে বড় করে দেখাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শামিক ভট্টাচার্য বলেছেন, “বাংলাদেশি বই এবং পশ্চিমবঙ্গের বাংলা বইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এটি সেই প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়েছে।”
বিশ্লেষণ: ভাষা ও রাজনীতির সংঘাত
এই ঘটনা কেবল একটি ভাষাগত ভুল নয়, বরং ভারতের জটিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গতিশীলতার প্রতিফলন। বাংলা ভাষা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগি করা একটি ঐতিহ্য। তবে ভারতে, এটি জাতীয় পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দিল্লি পুলিশের চিঠির ভাষা বাংলাভাষীদের মনে এই ধারণা তৈরি করেছে যে তাদের ভাষাকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটি বিশেষত সংবেদনশীল কারণ বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষীদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ বারবার উঠেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন যে হরিয়ানা, রাজস্থান এবং অন্যান্য রাজ্যে বাংলাভাষীদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে এবং তাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
এই বিতর্ক ভারতের ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন তুলেছে। ভারতের সংবিধানে ২২টি ভাষা স্বীকৃত, এবং বাংলা তার মধ্যে অন্যতম। এই ধরনের ঘটনা ভাষাগত পরিচয়ের প্রতি অসম্মান হিসেবে দেখা হয়, যা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে আরো জটিল করে তোলে। টিএমসির দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি বিজেপির “বাংলা-বিরোধী” মনোভাবের প্রমাণ। অন্যদিকে, বিজেপির দাবি, এটি শুধুমাত্র প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত একটি শব্দ।
বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
বাংলা ভাষা ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি মূল স্তম্ভ। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য, কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লবী কবিতা এবং ভারতের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে বিশ্বে পরিচিত। বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকা এবং বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে “বাংলাদেশি” বলে চিহ্নিত করা ভারতের বাংলাভাষীদের জন্য তাদের জাতীয় পরিচয়ের উপর আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
উপসংহার
দিল্লি পুলিশের এই চিঠি একটি প্রশাসনিক ভুল হিসেবে শুরু হলেও, এটি ভারতের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কে রূপ নিয়েছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং একটি জাতির পরিচয়, গর্ব এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। টিএমসি এবং অন্যান্য দল এই ঘটনাকে বাংলা ভাষার অপমান হিসেবে দেখলেও, বিজেপি এটিকে প্রেক্ষাপটের ভুল বোঝাবুঝি বলে দাবি করছে। তবে এই বিতর্ক ভারতের বহুভাষিক ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান এবং সংবেদনশীলতার গুরুত্বকে পুনরায় সামনে এনেছে।
সূত্র:
দিল্লি পুলিশের চিঠি নিয়ে বিতর্ক, Indian Express
বিজেপির প্রতিরক্ষা, Economic Times