Home / জীবনধারা / স্বাস্থ্য / রক্তে সুগার বেড়ে গেলে করণীয় ও প্রতিরোধ

রক্তে সুগার বেড়ে গেলে করণীয় ও প্রতিরোধ

++

হাইপারগ্লাইসেমিয়া হলো রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক সীমার ওপরে চলে যাওয়া। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুব সাধারণ সমস্যা, তবে কখনো কখনো ডায়াবেটিস না থাকলেও বিশেষ স্বাস্থ্য সমস্যায় দেখা দিতে পারে। টাইপ ১, টাইপ ২, অথবা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস – যে কোনো ধরনের ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হতে পারে।

হাইপারগ্লাইসেমিয়া বনাম হাইপোগ্লাইসেমিয়া

অনেকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া ও হাইপোগ্লাইসেমিয়া শব্দ দুটি গুলিয়ে ফেলেন।

1. হাইপোগ্লাইসেমিয়া (Hypoglycemia):

রক্তে শর্করা স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাওয়া।এতে হঠাৎ মাথা ঘোরা, ঘাম হওয়া, দুর্বলতা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া পর্যন্ত হতে পারে।

2. হাইপারগ্লাইসেমিয়া (Hyperglycemia):

রক্তে শর্করা স্বাভাবিকের উপরে বেড়ে যাওয়া। দীর্ঘদিন অবহেলা করলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অর্থাৎ, দুটো অবস্থাই একে অপরের বিপরীত।

হাইপারগ্লাইসেমিয়ার সম্ভাব্য কারণ

ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে সুগার বেড়ে যাওয়ার সাধারণ কারণগুলো হলো—

1. অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস

স্ট্রেসের সময় শরীরে কর্টিসল হরমোন বেড়ে যায়, যা রক্তে শর্করা বাড়ায়।

2. অসুস্থতা যেমন সর্দি‑কাশি, সংক্রমণ বা জ্বর

অসুস্থ অবস্থায় শরীর সুগার নিয়ন্ত্রণে কম সক্ষম হয়।

3. বেশি খাবার খাওয়া বা অযথা স্ন্যাকস খাওয়া

অসুস্থ অবস্থায় শরীর সুগার নিয়ন্ত্রণে কম সক্ষম হয়।

4. ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের অভাব

নিয়মিত ব্যায়াম না করলে শরীর অতিরিক্ত গ্লুকোজ ব্যবহার করতে পারে না।

5. ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিন ঠিকমতো না খাওয়া

ডোজ মিস করলে বা ভুল ডোজ নিলে রক্তে শর্করা বেড়ে যায়।

6. স্টেরয়েড জাতীয় কিছু ওষুধ সেবন করা

স্টেরয়েড শরীরে শর্করার লেভেল বাড়াতে পারে।

7. হঠাৎ করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে অতিরিক্ত গ্লুকোজ গ্রহণ

অতিরিক্ত চিনি খেলে পরে সুগার অনেক বেড়ে যেতে পারে।

রক্তে শর্করার স্বাভাবিক সীমা

পরীক্ষা স্বাভাবিক লেভেল

খালি পেটে (Fasting) 4 – 7 mmol/L বা 70 – 99 mg/dL

খাবারের ২ ঘণ্টা পর 8.5 – 9 mmol/L পর্যন্ত

HbA1c (৩ মাসের গড়) 6.5% বা 48 mmol/mol এর নিচে

হাইপারগ্লাইসেমিয়ার সাধারণ লক্ষণ

1. অতিরিক্ত তৃষ্ণা ও মুখ শুকিয়ে আসা
শরীর পানি হারায়, ফলে বারবার পানি খেতে ইচ্ছে করে।

2. ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
অতিরিক্ত শর্করা প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়, ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব লাগে।

3. ক্লান্তি ও শরীর দুর্বল লাগা
শরীর গ্লুকোজ ব্যবহার করতে না পারায় শক্তি কমে যায়।


4. ঝাপসা দৃষ্টি
রক্তে অতিরিক্ত শর্করা চোখের লেন্সে প্রভাব ফেলে।


5. চেষ্টা ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া
শরীর শক্তি পেতে চর্বি ভাঙতে শুরু করে, ফলে ওজন কমে যায়।


6. বারবার ইনফেকশন হওয়া
সুগার বেশি থাকলে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস দ্রুত বাড়ে।


7. পেটব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
শরীর কিটোন জমতে শুরু করলে এই লক্ষণ দেখা দেয়।


8. নিঃশ্বাসে মিষ্টি গন্ধ পাওয়া
ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসের একটি ক্লাসিক লক্ষণ।

হাইপারগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি ও জটিলতা

দীর্ঘদিন সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে—

1. ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস (DKA)

শরীরে অতিরিক্ত কিটোন জমে যায় । সাধারণত টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের হয়। সঠিক চিকিৎসা না নিলে কোমা পর্যন্ত হতে পারে।

2. হাইপারঅসমোলার হাইপারগ্লাইসেমিক স্টেট (HHS)

রক্তে সুগার খুব বেশি হলে শরীর পানি বের করে দেয়। ফলে মারাত্মক পানিশূন্যতা হয়। সাধারণত টাইপ ২ ডায়াবেটিসে হয়।

3. দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি

চোখ, কিডনি, স্নায়ু ও রক্তনালীর স্থায়ী ক্ষতি। জীবনমান কমে যায়।

রক্তে সুগার বেড়ে গেলে করণীয়

1. খাবার নিয়ন্ত্রণ করুন
মিষ্টি, কেক, কোমল পানীয়, চকলেট ও প্যাকেটজাত স্ন্যাকস এড়িয়ে চলুন।


2. প্রচুর পানি পান করুন
শরীরের পানিশূন্যতা পূরণ হয় ও অতিরিক্ত সুগার বের হয়।

3. হালকা ব্যায়াম করুন
প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

4. ওষুধ বা ইনসুলিন ডোজ মেনে চলুন
নিজে থেকে ডোজ পরিবর্তন নয়, প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

5. নিয়মিত সুগার চেক করুন
গ্লুকোমিটার দিয়ে নিয়মিত রক্তে সুগার মাপুন। কিটোন টেস্ট করলে জটিলতা আগেভাগে ধরা পড়ে।

কখন জরুরি চিকিৎসা নেবেন

বমি বা ডায়রিয়া শুরু হলে
– শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়

শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত ও গভীর হলে
– কিটোন বেড়ে গেলে শ্বাসকষ্ট হয়

২৪ ঘণ্টার বেশি জ্বর থাকলে
– সংক্রমণ সুগার বাড়িয়ে দেয়

মাথা ঘোরা বা সজাগ থাকতে কষ্ট হলে
– শরীর বিপদ সংকেত দিচ্ছে

পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দিলে
– ঠোঁট শুকিয়ে যাওয়া, হৃদস্পন্দন দুর্বল হওয়া

হাইপারগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধের উপায়

1.সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন। চিনি, মিষ্টি ও হাই‑কার্ব খাবার কমান।
2. ডাক্তারের চিকিৎসা পরিকল্পনা অনুসরণ করুন। সময়মতো ওষুধ ও ইনসুলিন নিন।
3. সক্রিয় থাকুন ও নিয়মিত ব্যায়াম করুন। শরীর অতিরিক্ত গ্লুকোজ ব্যবহার করতে পারবে।
4. অসুস্থ অবস্থায় বাড়তি যত্ন নিন। অসুস্থতায় নিয়মিত সুগার মনিটর করুন।
5. রক্তে সুগার নিয়মিত পরীক্ষা করুন। গ্লুকোমিটার ব্যবহার করুন ও প্রতি ২‑৩ মাসে HbA1c করুন।

হাইপারগ্লাইসেমিয়া অবহেলা করলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে।
তাই—

সুষম খাদ্যাভ্যাস

নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত পানি

সঠিক ওষুধ গ্রহণ

নিয়মিত পর্যবেক্ষণ


এই চারটি নিয়ম মেনে চললে রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

Tagged:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *